আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ফের নতুন উদ্যমে মাঠে নামছে বিএনপির তিন অঙ্গ-সহযোগী সংগঠন—জাতীয়তাবাদী যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও ছাত্রদল। তরুণ সমাজকে আকৃষ্ট করতে এবং তাদের রাজনৈতিক কার্যক্রমে সম্পৃক্ত করতে এবার তারা ঢাকাসহ দেশের চারটি বিভাগীয় শহরে বড় পরিসরে “তারুণ্যের সমাবেশ” করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে এই কর্মসূচি শুরু হতে পারে এবং পরিকল্পনা অনুযায়ী পবিত্র ঈদুল আজহার আগেই তা শেষ করা হবে।
সমাবেশগুলোর মধ্য দিয়ে বিএনপি তাদের প্রধান রাজনৈতিক বার্তা ছড়িয়ে দিতে চায়। তারা দাবি করছে, দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে তরুণ ভোটারদের অধিকার হরণ করা হয়েছে। তাই অবিলম্বে নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক একটি জাতীয় নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার জন্য তারা সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করতে চায়।
তারুণ্যের সমাবেশের পরিকল্পনা ও লক্ষ্য
আজ সোমবার সকাল সাড়ে ১১টায় রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও ছাত্রদলের যৌথ সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। সেখানে আনুষ্ঠানিকভাবে দেশব্যাপী তারুণ্যের সমাবেশের কর্মসূচি ঘোষণা করা হতে পারে। কর্মসূচির আওতায় চারটি বিভাগীয় শহরে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে। তবে দুটি বিভাগ মিলে একটি করে সমাবেশ করার পরিকল্পনা রয়েছে, অর্থাৎ মোট চারটি বৃহৎ সমাবেশ হবে।
সূত্র মতে, চট্টগ্রাম থেকে তারুণ্যের সমাবেশের শুরু হবে এবং রাজধানী ঢাকায় এসে তা শেষ হবে। সম্ভাব্য অন্যান্য স্থানগুলোর মধ্যে সিলেট, বরিশাল এবং রাজশাহী বা খুলনা অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে। প্রতিটি সমাবেশে ব্যাপক জনসমাগম ঘটানোর জন্য জেলা ও মহানগর পর্যায়ে তৃণমূল নেতাকর্মীদের ইতোমধ্যে প্রস্তুতি নিতে বলা হয়েছে।
এই সমাবেশগুলোতে বিশেষ করে তরুণ ভোটারদের উদ্দেশে বার্তা দেওয়া হবে, যাতে তারা তাদের ভোটাধিকার ফিরিয়ে আনতে এবং গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে সক্রিয় ভূমিকা রাখে। বিএনপি মনে করে, ২০০৮ সালের পর থেকে আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে হওয়া তিনটি জাতীয় নির্বাচনে প্রকৃত অর্থে তরুণ ভোটাররা ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেনি। তাদের অভিযোগ, নানা অনিয়ম ও কারচুপির মাধ্যমে এসব নির্বাচনের ফলাফল নির্ধারিত হয়েছে। এ প্রেক্ষাপটে এবার তারা তরুণদের জাগ্রত করতে চায়, যাতে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে নতুন প্রাণসঞ্চার হয়।
পূর্ববর্তী অভিজ্ঞতা ও চলমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট
২০২৩ সালে একই ধরনের উদ্যোগ নিয়েছিল যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও ছাত্রদল। তখন দেশের ছয়টি বড় শহরে যৌথভাবে তারুণ্যের সমাবেশ আয়োজন করা হয়েছিল। সে বছরের ১৪ জুন চট্টগ্রামে, ১৯ জুন বগুড়ায়, ২৪ জুন বরিশালে, ৯ জুলাই সিলেটে এবং ১৭ জুলাই খুলনায় সমাবেশের পর ২২ জুলাই ঢাকায় একটি বৃহৎ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।
ওইসব সমাবেশ ছিল মূলত সরকারবিরোধী আন্দোলনের প্রস্তুতির অংশ। ঢাকার শেষ সমাবেশের পর একদফা দাবিতে—প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের দাবিতে—২৯ জুলাই রাজধানী ঢাকার চার প্রবেশমুখে অবস্থান কর্মসূচি পালন করে বিএনপি ও তাদের সহযোগী সংগঠনগুলো। তবে, প্রত্যাশিত জনসমাগম না হওয়ায় এবং নেতাকর্মীদের সক্রিয় উপস্থিতির অভাবে ওই কর্মসূচি সফল হতে পারেনি। এরপরও বিএনপি ধারাবাহিকভাবে তাদের আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে এবং এবার নতুন করে তারুণ্যের সমাবেশের মাধ্যমে মাঠে আবার শক্তভাবে ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
তারুণ্য নির্ভর নতুন কৌশল
বর্তমান সময়ে দেশের তরুণ জনগোষ্ঠী একটি বিশাল শক্তি। তরুণদের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, সামাজিক সচেতনতা এবং ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহারে দক্ষতা বর্তমান রাজনৈতিক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। বিএনপি এই বাস্তবতা উপলব্ধি করেই আবার তরুণদের কেন্দ্র করে নতুন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।
তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী, তারুণ্যের সমাবেশে মূলত শিক্ষা, কর্মসংস্থান, বাকস্বাধীনতা, মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক অধিকার ইত্যাদি ইস্যু সামনে আনা হবে। পাশাপাশি তরুণ প্রজন্মের হতাশা, বেকারত্বের যন্ত্রণা এবং স্বাধীন মত প্রকাশের প্রতিবন্ধকতা তুলে ধরে তাদের আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতিশীল করে তোলা হবে।
এছাড়া বিএনপির পক্ষ থেকে তরুণ ভোটারদের উদ্দেশে একটি স্পষ্ট বার্তা দেওয়া হবে—ভোটাধিকার রক্ষায় আগামী জাতীয় নির্বাচনে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে হবে এবং গণতন্ত্রের স্বার্থে তাদের দৃঢ় অবস্থান নিতে হবে।
সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ ও প্রস্তুতি
অতীত অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে, আন্দোলন কর্মসূচির সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বাধা, গ্রেফতার, দমন-পীড়ন ইত্যাদি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দাঁড়াতে পারে। তাই এবার আগেভাগেই সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীদের প্রস্তুত করা হচ্ছে যাতে সমাবেশগুলো শান্তিপূর্ণ, সুশৃঙ্খল এবং সুসংগঠিত হয়।
প্রত্যেক বিভাগীয় সমাবেশের জন্য আলাদা আলাদা সমন্বয় কমিটি গঠন করা হবে। এই কমিটিগুলো স্থানীয় পর্যায়ে প্রস্তুতি নেবে, জনসংযোগ করবে এবং তরুণদের আহ্বান জানাবে সমাবেশে যোগ দেওয়ার জন্য।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও ব্যাপক প্রচারণা চালানোর পরিকল্পনা রয়েছে। সমাবেশের বিভিন্ন দিক তুলে ধরতে ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউবসহ বিভিন্ন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করা হবে। তরুণদের আবেগ এবং আকাঙ্ক্ষাকে সম্মান জানিয়ে তাদের মাঝে উৎসাহ ও উদ্দীপনা ছড়িয়ে দেওয়া হবে।
চলতি বছর দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন অস্থির ও উত্তপ্ত। এই পরিস্থিতিতে বিএনপির তারুণ্যের সমাবেশ নতুন মাত্রা যোগ করতে পারে। সফলভাবে এই কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা গেলে দলটির আন্দোলন সংগ্রামে নতুন গতি সঞ্চার হতে পারে এবং তরুণ সমাজের একটি বৃহৎ অংশকে তারা তাদের পক্ষে টানতে সক্ষম হতে পারে।
সমাবেশগুলোর মাধ্যমে তরুণদের মধ্যে ভোটাধিকার ও গণতন্ত্র সম্পর্কে নতুন করে সচেতনতা তৈরি হবে—এমনটাই প্রত্যাশা করছে বিএনপি নেতৃত্ব। তবে সবকিছু নির্ভর করছে মাঠপর্যায়ে সংগঠনগুলোর প্রস্তুতি, নেতৃত্বের দৃঢ়তা এবং সর্বোপরি জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের উপর।