জয়পুরহাট, ৪ আগস্ট ২০২৪ – জয়পুরহাটে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান পাঁচবিবি উপজেলার তরুণ ছাত্র নজিবুল সরকার ওরফে বিশাল। উপজেলার নাকুরগাছি কারিগরি কলেজের শিক্ষার্থী বিশাল ছিলেন ধরঞ্জি ইউনিয়নের রতনপুর গ্রামের মজিদুল সরকার ও বুলবুলী খাতুন দম্পতির বড় ছেলে।
অত্যন্ত মেধাবী, সুদর্শন ও সাহসী বিশাল ছিলেন গ্রামের সবার প্রিয়। ছোট ভাই মোমিন তখন দশম শ্রেণির ছাত্র। বৃদ্ধ বাবা মজিদুল সরকার দিনমজুরের কাজ করতেন, আর মা বুলবুলী খাতুন সংসারের কাজের পাশাপাশি হাঁস-মুরগি ও ছাগল পালতেন। অভাবের সংসারে থেকেও বিশাল সবসময় পরিবারের প্রতি দায়িত্বশীল ছিলেন। কিন্তু বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে জীবন দিতে হলো তাকে।
মায়ের আহাজারি: “খুনি হাসিনা আমার ছেলেটারে বাঁচতে দিল না”
ছেলে হারানোর কষ্টে আজও ভেঙে পড়েন মা বুলবুলী খাতুন। চোখ মুছতে মুছতে বলেন,
“খুনি হাসিনা আমার ছেলেটারে বাঁচতে দিল না, গুলি করে মেরে ফেলল। আল্লাহ যেন খুনি হাসিনার বিচার করে।”
প্রাণ দিতে প্রস্তুত ছিল বিশাল
বন্ধুরা জানান, বিশাল খুব সাহসী ছিলেন, মিছিলের সামনে থাকতে পছন্দ করতেন। সেদিন, ৪ আগস্ট, জয়পুরহাট শহরের প্রধান সড়কে বিশাল নেতৃত্ব দিচ্ছিল। পুলিশের বাধার মুখে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া শুরু হয়। একপর্যায়ে পুলিশ এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়লে একটি গুলি বিশালের ডান পাঁজর ভেদ করে বাম পাশ দিয়ে বেরিয়ে যায়। মাটিতে লুটিয়ে পড়া বিশালকে দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
বন্ধুদের কাছে বিশাল আগেই বলেছিলেন,
“আমার বাবা-মাকে দেখার জন্য ছোট ভাই আছে। প্রয়োজনে শহীদ হব।”
তার এই কথা সত্যি হয়ে গেল।
শেষ বিদায়: শোকার্ত জনতার কান্না
সেদিন রাত ১০টায় নিজ গ্রামে বিশালের জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। শত ভয় ও আতঙ্কের মাঝেও সহস্রাধিক মানুষ জানাজায় অংশ নেন।
মা বুলবুলী খাতুন কাঁদতে কাঁদতে বলেন,
“আমার ছেলেটারে গ্রামের সবাই ভালোবাসত। সে মাঝে মাঝে হঠাৎ বেরিয়ে যেত, বলত বন্ধুরা মিলে ঘুরতে গেছে। আমি বুঝিনি সে মিছিলে যেত! যদি জানতাম, তাহলে যেতে দিতাম না।”
সকালের বিদায়, সন্ধ্যায় লাশ হয়ে ফেরা
৪ আগস্টের সকালটা ছিল অন্য দিনের চেয়ে ভিন্ন। ফজরের নামাজ পড়ে নীরব ছিল বিশাল। সকাল ৯টার দিকে মা’কে বলে,
“মা, আমাকে জয়পুরহাট যেতে হবে। তোমার ওষুধটা আনা দরকার।”
মা বলেছিলেন,
“বাবা, এই গণ্ডগোলের মধ্যে না গেলেই হয় না?”
কিন্তু বিশাল জেদ ধরে বলেছিল,
“না মা, আমাকে যেতেই হবে। ওরা (বন্ধুরা) সবাই অপেক্ষা করছে।”
সাড়ে ৯টার দিকে সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় ছোট ভাই মোমিনকে বলেছিল—
“আমরা দাবি আদায়ের জন্য মিছিলে যাচ্ছি। যদি কিছু হয়ে যায়, তাহলে বাবা-মাকে বলিস, তারা যেন ১০টা এতিমকে খাওয়ায়।”
এই কথাগুলো বলতে বলতে মা ডুকরে কেঁদে ওঠেন।
“আমি যদি জানতাম, তাহলে কি ওকে যেতে দিতাম? বারবার রাস্তার দিকে তাকাচ্ছিলাম, কখন ফিরে আসে। কিন্তু ফিরে এলো… অ্যাম্বুলেন্সে লাশ হয়ে।”
বাবার দাবি: রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও বিচার
বাবা মজিদুল সরকার বলেন,
“বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে যারা শহীদ হয়েছেন, তাদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়া হোক। আর খুনি হাসিনার উপযুক্ত শাস্তি হক— তাহলেই আমার বিশালের আত্মা শান্তি পাবে।”
/আমারদেশ