জুলাই গণহত্যা: জাতিসংঘের তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশের পর বিতাড়িত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফেরত পাঠানোর বিষয়ে ভারতের ওপর নতুন করে আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি হয়েছে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, আগামী দিনগুলোতে এই চাপ আরও বৃদ্ধি পাবে এবং জাতিসংঘকে বিচারের প্রক্রিয়ায় যুক্ত করা গেলে ভারত আরও সংকটে পড়বে।
গত ১২ ফেব্রুয়ারি জেনেভায় জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার ভলকার তুর্ক এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে জুলাই গণহত্যার তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ করেন। এতে বলা হয়েছে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রত্যক্ষ পরিকল্পনা ও নির্দেশনার ভিত্তিতেই এই গণহত্যা সংঘটিত হয়েছিল। তার নির্দেশেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিক্ষোভরত ছাত্রদের গুলি করে হত্যার পর লাশ গুম করে ফেলে। রিপোর্ট অনুযায়ী, এই হত্যাকাণ্ডে অন্তত ১,৪০০ মানুষ নিহত হয়েছে, যার মধ্যে ১৩ শতাংশ ছিল শিশু।
জাতিসংঘের এ রিপোর্ট প্রকাশের পর বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এক আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে স্পষ্ট করেছেন, শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে বিচার করা হবে।
ভারতের ওপর চাপ বাড়ছে
জাতিসংঘের প্রতিবেদনে শেখ হাসিনাকে গণহত্যার মূল হোতা হিসেবে চিহ্নিত করার পরই ভারতের আশ্রয়ে থাকা এই সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বিচার দাবি আরও জোরালো হয়েছে। বিএনপি এতদিন এ বিষয়ে নীরব থাকলেও জাতিসংঘের রিপোর্ট প্রকাশের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে ভারতকে শেখ হাসিনাকে ফেরত পাঠানোর আহ্বান জানান।
জাতিসংঘও গণহত্যায় অভিযুক্তদের বিচারের আওতায় আনার আহ্বান জানিয়েছে। হাইকমিশনার ভলকার তুর্ক বলেন, “বাংলাদেশে জুলাই গণহত্যায় জড়িত সবাইকে আইনের মুখোমুখি করতে হবে। কেউ যেন দায়মুক্তি না পায়।”
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারও ইতোমধ্যে শেখ হাসিনাকে ফেরত পাঠাতে ভারতের প্রতি আনুষ্ঠানিক নোটিস দিয়েছে। ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, “জাতিসংঘের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং রিপোর্ট শেখ হাসিনার অপরাধের অকাট্য প্রমাণ। আমরা তার বিচারের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করেছি এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহায়তা চাই।”
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের মতামত
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ভারতের ওপর চাপ বাড়াতে হলে জাতিসংঘের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। সাবেক পররাষ্ট্রসচিব এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “ভারত জানত, শেখ হাসিনা কীভাবে বিক্ষোভ দমনে রক্তপাত ঘটিয়েছে। জাতিসংঘের রিপোর্ট প্রকাশের পর ভারতকে এখন আর বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। বাংলাদেশ সরকার যদি জাতিসংঘের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক উদ্যোগ নেয়, তাহলে ভারত আরও চাপে পড়বে।”
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক এম শহীদুজ্জামান বলেন, “শেখ হাসিনা এখন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একজন গণহত্যাকারী। ভারত তাকে আশ্রয় দিয়ে গণহত্যার পক্ষ নিয়েছে। এটি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তুলে ধরতে হবে।”
যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবীর বলেন, “এখন ভারত যদি শেখ হাসিনাকে ফেরত পাঠাতে গড়িমসি করে, তাহলে তারা আন্তর্জাতিকভাবে গণহত্যার দায়মুক্তি থেকে নিজেদের মুক্ত রাখতে পারবে না।”
শেখ হাসিনার বিচার নিয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ
জাতিসংঘের রিপোর্ট প্রকাশের পর বাংলাদেশের সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলো একসঙ্গে শেখ হাসিনার বিচারের বিষয়ে সোচ্চার হয়েছে। বিষয়টি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যেতে জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (ICC)-এর সহায়তা নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, “আমরা জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক আদালতের মাধ্যমে এই বিচার নিশ্চিত করব। ভবিষ্যতে যেন আর কখনও এ ধরনের গণহত্যা না ঘটে, তার জন্য দোষীদের অবশ্যই আইনের আওতায় আনতে হবে।”
জুলাই গণহত্যার মূল হোতা শেখ হাসিনাকে ফিরিয়ে আনতে ভারতের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ অব্যাহত রয়েছে। পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে, তাতে ভারতের জন্য বিষয়টি আরও জটিল হয়ে উঠবে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
সুত্র: আমারদেশ