বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, ব্যক্তি নয়, দল বড়, আর দলের চেয়ে দেশ সবার আগে। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আদর্শ স্মরণ করিয়ে দিয়ে তিনি নেতাকর্মীদের সতর্ক থাকার আহ্বান জানান।
বৃহস্পতিবার (২৭ ফেব্রুয়ারি) সকালে জাতীয় সংসদ ভবনের এলডি হলে বিএনপির বর্ধিত সভায় ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে তিনি এসব কথা বলেন।
তারেক রহমান বলেন, বিএনপির প্রতিটি নেতাকর্মীর দীর্ঘদিনের ত্যাগ-তিতিক্ষা তিনি গভীরভাবে উপলব্ধি করেন। তবে দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গের ক্ষেত্রে কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে তিনি বাধ্য হয়েছেন এবং ভবিষ্যতেও দলের স্বার্থে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিতে হবে। দলীয় শৃঙ্খলা বা ভাবমূর্তির ক্ষতি হয়—এমন কোনো কর্মকাণ্ড বিএনপি কোনোভাবেই বরদাশত করবে না।
তিনি বলেন, বিএনপি আজ শুধু একটি রাজনৈতিক দল নয়, এটি দেশের স্বাধীনতাকামী গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষের আস্থার প্রতীক। এজন্য দলের প্রতিটি নেতাকর্মীকে আরও দায়িত্বশীল হতে হবে, সতর্ক আচরণ করতে হবে।
দীর্ঘ সাত বছর পর অনুষ্ঠিত এই বর্ধিত সভার গুরুত্ব তুলে ধরে তারেক রহমান বলেন, ২০১৮ সালের ৪ ফেব্রুয়ারির সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন বেগম খালেদা জিয়া। এরপর ফ্যাসিবাদী শাসনের কারণে আর বর্ধিত সভা বা কাউন্সিল আয়োজন সম্ভব হয়নি। চিকিৎসাধীন থাকায় বেগম খালেদা জিয়া এবার সরাসরি উপস্থিত থাকতে না পারলেও, তিনি সভার সফলতা কামনা করেছেন এবং দলের নেতাকর্মীদের দোয়া চেয়েছেন।
তারেক রহমান বলেন, শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান একদলীয় বাকশাল বাতিল করে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। নিষিদ্ধ রাজনৈতিক দলগুলোকে রাজনীতি করার সুযোগ দিয়েছিলেন। তার হাত ধরেই গণতন্ত্রের যে পথচলা শুরু হয়েছিল, বিএনপি সেটির উত্তরাধিকার বহন করছে।
তিনি আরও বলেন, বিএনপি জন্মলগ্ন থেকে গণতন্ত্র ও স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। এই সংগ্রামে যারা শহীদ হয়েছেন, যাদের ত্যাগে বিএনপি আজ দেশের অন্যতম জনপ্রিয় রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে, তিনি তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
তারেক রহমান বলেন, দেশের জনগণ দীর্ঘদিন ফ্যাসিবাদী দুঃশাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। ২০২৪ সালে জাতীয় আন্দোলনে জীবন উৎসর্গকারী শহীদদের স্মরণ করে তিনি বলেন, তাদের রক্তের বিনিময়ে ফ্যাসিস্ট সরকার পতন হয়েছে, আর এখন জাতীয় পুনর্গঠনের এক নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু সেই সম্ভাবনাকে ব্যাহত করতে নানা ষড়যন্ত্র চলছে।
তিনি বলেন, ‘জাতীয় ঐক্য’ ও ‘জাতীয় নির্বাচনের’ পরিবেশ নষ্ট করার জন্য পরিকল্পিতভাবে বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে। যারা দেশকে তাবেদার রাষ্ট্রে পরিণত করতে চেয়েছিল, তারা এখনও সক্রিয়। বিএনপি জনগণের ভোটাধিকার ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের পক্ষে, তাই এ ধরনের ষড়যন্ত্র প্রতিহত করা হবে।
বিএনপির সংস্কার ভাবনার কথা তুলে ধরে তারেক রহমান বলেন, দল সবসময় সময়োপযোগী পরিবর্তনে বিশ্বাসী। অতীতেও বিএনপি রাষ্ট্র পরিচালনায় বিভিন্ন সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নিয়েছে এবং ভবিষ্যতেও জনগণের চাহিদার ভিত্তিতে সংস্কারের পথে এগিয়ে যাবে।
তিনি বলেন, দীর্ঘ দেড় দশক ধরে স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থা দেশে নানাবিধ সংকট সৃষ্টি করেছিল। শিক্ষা, প্রতিরক্ষা ও অর্থনীতি দুর্বল করে ফেলা হয়েছিল পরিকল্পিতভাবে। জনগণের ভোটাধিকার হরণ করে দেশকে অনিয়ন্ত্রিত দুর্নীতি ও দমন-পীড়নের শিকার হতে বাধ্য করা হয়েছিল।
তারেক রহমান বলেন, এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে বিএনপি ২০১৭ সালে ‘ভিশন ২০৩০’ ঘোষণা করে এবং পরে ২০২২ সালে ২৭ দফা ও পরবর্তীতে ৩১ দফার রূপরেখা প্রকাশ করে। এই ৩১ দফার মূল লক্ষ্য একটি—একটি নিরাপদ, গণতান্ত্রিক, মানবিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করা।
তিনি আরও বলেন, রাষ্ট্র, সরকার ও রাজনীতির সংস্কারের জন্য বিএনপির ৩১ দফার সঙ্গে প্রয়োজন হলে নতুন সংযোজন-বিয়োজন করা হবে। জনগণের স্বার্থেই বিএনপি পরিবর্তনমুখী চিন্তাধারায় বিশ্বাসী।
জাতীয় নির্বাচন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে জনগণের মনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। স্থানীয় নির্বাচন আয়োজনের উদ্যোগের বিষয়ে তিনি বলেন, এটি গণতন্ত্রের পুনরুদ্ধারের পথকে বিভ্রান্ত করতে পারে, যা বিএনপি সমর্থন করবে না।
তারেক রহমান নেতাকর্মীদের উদ্দেশে বলেন, দীর্ঘদিন ধরে তিনি সবার সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছেন। তিনি বিশ্বাস করেন, ত্যাগী ও সাহসী কর্মীদের নিয়ে বিএনপিকে দমিয়ে রাখা যাবে না। তিনি বলেন, বিএনপি এমন একটি বাংলাদেশ চায় যেখানে সব ধর্ম-বর্ণের মানুষ সমান অধিকার ভোগ করবে এবং জাতীয় স্বার্থই হবে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি।
তিনি আরও বলেন, বিএনপি বহুদলীয় গণতন্ত্রে বিশ্বাসী এবং নতুন রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশকে স্বাগত জানায়। তবে জনগণই চূড়ান্তভাবে সিদ্ধান্ত নেবে, কোন দল গ্রহণযোগ্য। এজন্য অবাধ ও সুষ্ঠু জাতীয় নির্বাচন নিশ্চিত করা জরুরি।
তিনি বলেন, জনগণের ভোটাধিকার পুনরুদ্ধার এবং তা সঠিকভাবে প্রয়োগের নিশ্চয়তা দিতে বিএনপি এমন একটি সরকার প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দেয়, যা জনগণের কাছে জবাবদিহি করবে।
বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের উদ্দেশে তারেক রহমান বলেন, দলীয় ঐক্য বজায় রাখতে হবে। ভিন্নমত থাকতেই পারে, তবে তা যেন বিভাজন সৃষ্টি না করে। ঐক্যের শক্তি বিএনপিকে বারবার বিজয়ের দিকে এগিয়ে নিয়েছে, ভবিষ্যতেও তা অব্যাহত রাখতে হবে।
তিনি বলেন, বিএনপি জনগণের আস্থা অর্জন করেছে, তাই চক্রান্তকারীরা সক্রিয়। সুতরাং দলকে আরও সুসংগঠিত ও শক্তিশালী করতে হবে। জাতীয় নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে আসছে, তাই সবাইকে প্রস্তুত থাকতে হবে।
পরিশেষে তিনি জনগণের উদ্দেশে বলেন, বিএনপি শুধু ভোটের অধিকার পুনরুদ্ধারের প্রতিশ্রুতি দেয় না, বরং তা সঠিকভাবে প্রয়োগের নিশ্চয়তাও দিতে চায়। তিনি সকলের সমর্থন ও সহযোগিতা কামনা করেন এবং দলীয় নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানান।