বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গন এখন নির্বাচনী তৎপরতায় সরব। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ও সমমনা রাজনৈতিক শক্তিগুলো দ্রুত জাতীয় নির্বাচন দেওয়ার জন্য সরকারকে চাপ দিয়ে যাচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে, নির্বাচন কমিশন চলতি বছরের ডিসেম্বর বা আগামী বছরের মার্চের মধ্যে জাতীয় নির্বাচনের আয়োজন করতে পারে। এই ঘোষণার পর থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর তৎপরতা আরও বেড়েছে।
নতুন রাজনৈতিক সমীকরণ তৈরি হচ্ছে। গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারাও নতুন দল গঠনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান ও কৌশল নিয়ে সাধারণ জনগণের মধ্যেও কৌতূহল তৈরি হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, প্রধান দলগুলো তিনটি বড় জোট গঠন করে নির্বাচনে অংশ নিতে পারে। তবে একসময়ের ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ আদৌ নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে কি না, তা এখনো নিশ্চিত নয়।
বিএনপির অবস্থান ও কৌশল
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর নির্বাচন নিয়ে পরিষ্কারভাবে কিছু বলেননি। তিনি জানিয়েছেন, ‘নির্বাচন যখন ঘনিয়ে আসবে, তখন জোট গঠনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। আমরা যুগপৎ আন্দোলনে ছিলাম, কিন্তু জোট গঠনের কোনো আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিইনি। নির্বাচনের প্রাক্কালে পরিস্থিতি বুঝে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’
বিএনপির শীর্ষ নেতারা মনে করছেন, শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর তাদের জন্য নির্বাচন সহজ হবে বলে যে ধারণা ছিল, বাস্তবে তা এতটা সহজ নয়। বরং দিন দিন রাজনৈতিক সমীকরণ জটিল হয়ে উঠছে। বিএনপি এখন নতুন কৌশল নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। দলটি ক্ষমতায় ফেরার জন্য ছাড় দিয়ে হলেও বিভিন্ন দলকে নিজেদের সঙ্গে জোটবদ্ধ করতে চায়।
জামায়াতের তৎপরতা ও সম্ভাব্য জোট
জামায়াতে ইসলামীও রাজনৈতিক পুনর্বাসনের আশায় রয়েছে। বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার পাশাপাশি দলটি নিজস্ব শক্তিরও প্রমাণ দিতে চায়। এজন্য ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ (চরমোনাই পীর) ও হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশকে একত্রিত করার চেষ্টা চালাচ্ছে। তবে আদর্শগত পার্থক্যের কারণে এসব দলকে জামায়াত তাদের সঙ্গে আনতে পারবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।
চরমোনাই পীরের দল ও হেফাজতে ইসলাম অতীতে জামায়াতের কঠোর সমালোচনা করেছে এবং বিভিন্ন বিষয়ে ভিন্ন অবস্থান নিয়েছে। ফলে জামায়াতের নেতৃত্বে কোনো ধর্মভিত্তিক জোট গঠনের সম্ভাবনা কম বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
এবি পার্টির অবস্থান
এবি পার্টির সভাপতি মজিবুর রহমান মঞ্জু স্পষ্ট করেছেন যে তারা ধর্মীয় দলের নেতৃত্বাধীন কোনো জোটে যুক্ত হবে না। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশসহ এই উপমহাদেশে ধর্মীয় রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃত্বে যে জোট হয়েছে, তারা নির্বাচনে ভালো ফলাফল করতে পারেনি। বরং ধর্মভিত্তিক দলগুলো মেইনস্ট্রিম রাজনৈতিক শক্তির সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে তুলনামূলক ভালো ফল করেছে।’
তিনি আরও জানান, এবি পার্টির সামনে তিনটি বিকল্প পথ রয়েছে:
১. এককভাবে নির্বাচন করা
২. বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধ হওয়া
৩. নতুন রাজনৈতিক সমঝোতার ভিত্তিতে বিকল্প শক্তিগুলোর সঙ্গে জোট গঠন করা
তিনি আশাবাদী যে আসন্ন নির্বাচনে এই তিনটির মধ্যে যেকোনো একটি পথ তারা বেছে নেবে।
সম্ভাব্য তিনটি প্রধান জোট
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, আগামী নির্বাচনে দলগুলো তিনটি প্রধান জোট গঠন করতে পারে:
১. বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট – যেখানে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো থাকতে পারে।
2. জামায়াত ও অন্যান্য ইসলামপন্থী দলের জোট – জামায়াতে ইসলামী, চরমোনাই পীরের ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ এবং হেফাজতে ইসলাম এখানে থাকতে পারে। তবে আদর্শগত মতপার্থক্যের কারণে এ জোট নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে।
3. তৃতীয় রাজনৈতিক শক্তির জোট – ছাত্র আন্দোলন থেকে আসা নতুন দল ও এবি পার্টির মতো বিকল্পধারার দলগুলো নিয়ে গঠিত হতে পারে।
নির্বাচনের সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ
আগামী নির্বাচন ঘিরে রাজনৈতিক মেরুকরণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিএনপি, জামায়াত, এবি পার্টি ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলো কৌশলগত অবস্থান গ্রহণ করছে। সরকার নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করতে পারবে কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বিএনপির সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো সমমনা দলগুলোকে একত্রিত রাখা এবং জামায়াতসহ অন্য দলগুলোর সঙ্গে কৌশলগত সমঝোতা করা। জামায়াতের লক্ষ্য নির্বাচনকে তাদের পুনর্বাসনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা। অন্যদিকে এবি পার্টি ও নতুন রাজনৈতিক শক্তিগুলো নিজেদের আলাদাভাবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করছে।
আগামী নির্বাচনের রাজনীতি এখনও অনিশ্চিত। দলগুলো কীভাবে নিজেদের অবস্থান ঠিক করবে, তা নির্ভর করছে নির্বাচনের সময়সূচি ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপর। নির্বাচন ঘনিয়ে এলে দলগুলোর চূড়ান্ত কৌশল স্পষ্ট হয়ে উঠবে।