পুলিশ সংস্কার আইন: আধুনিকায়নের প্রয়োজন ও বর্তমান উদ্যোগ
বাংলাদেশ সরকার আবারও পুলিশ সংস্কার আইনকে আধুনিক করার উদ্যোগ নিয়েছে। এ লক্ষ্যে পুলিশের উচ্চ পর্যায়ের ৭ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে, যারা গত এক সপ্তাহ ধরে কাজ করছে। তাদের লক্ষ্য হলো, পুলিশ সংস্কার আইনকে আধুনিকায়ন করে খসড়া চূড়ান্ত করা।
পটভূমি: ২০০৭ সালের পুলিশ অর্ডিন্যান্স
পুলিশ সূত্র জানায়, ২০০৭ সালে সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে পুলিশ বাহিনীকে আধুনিকায়নের জন্য পুলিশ অর্ডিন্যান্স-২০০৭ প্রণয়ন করা হয়েছিল। প্রধান উপদেষ্টার অফিস, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ পুলিশ এবং জাতিসংঘ উন্নয়ন কার্যক্রমের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত টিম কক্সবাজারে একটি কর্মশালা আয়োজন করে এই অর্ডিন্যান্সের খসড়া প্রণয়ন শুরু করে। যদিও অর্ডিন্যান্সটি নিয়ে বেশ কয়েক দফা আলোচনা ও মতামত নেয়া হয়েছিল, তা রহস্যজনক কারণে বাস্তবায়ন হয়নি। অর্ডিন্যান্সটি কার্যকর হলে পুলিশকে জবাবদিহির আওতায় আনা যেত।
বর্তমান পুলিশ ব্যবস্থার চ্যালেঞ্জ
বাংলাদেশে পুলিশ বাহিনী এখনো ১৮৬১ সালের ব্রিটিশ আমলের আইন অনুযায়ী পরিচালিত হচ্ছে, যা আধুনিক গণতান্ত্রিক সমাজের জন্য যথোপযুক্ত নয়। উপনিবেশিক আমলে পুলিশ ছিল প্রভুদের সেবাদাস, এবং স্বাধীনতার পর থেকে রাজনৈতিক ক্ষমতাবানরা পুলিশের ওপর অবৈধ প্রভাব খাটিয়ে তাদের স্বার্থে ব্যবহার করেছে। এর ফলে পুলিশ বাহিনী প্রায়শই ক্ষমতাসীন সরকারের পেটোয়া বাহিনী হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে, যেখানে আইন প্রয়োগের নামে বিভিন্ন বেআইনি কার্যক্রম পরিচালিত হয়। জনগণের সেবা থেকে বিচ্যুত হয়ে ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে অবৈধ হস্তক্ষেপের ফলে পুলিশ বাহিনীর ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে।
সমসাময়িক পরিস্থিতি
সাম্প্রতিক সময়ের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে পুলিশ মরণাস্ত্র ব্যবহার করে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে মানুষ হত্যা করেছে, যার মধ্যে ছাত্র, শিশু এবং সাধারণ মানুষও ছিলেন। হত্যার পর লাশের তথ্য গোপন করতে ময়নাতদন্তের পর মর্গ থেকে নথিসহ অন্যান্য আলামতও গায়েব করা হয়েছে। এ ধরনের ঘটনা বাংলাদেশে পুলিশের আইনগত অবকাঠামোর অপ্রতুলতার কথা উল্লেখ করে, যা পুলিশের কাজকে জবাবদিহির আওতায় আনতে ব্যর্থ হয়েছে।
আইনের শাসন ও পুলিশের দায়িত্ব
পুলিশ সংস্কার আইনকে আধুনিকায়নের মাধ্যমে পুলিশের ওপর থেকে অবৈধ প্রভাবমুক্ত করে ন্যায়সঙ্গতভাবে এবং আইনের শাসনের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করা জরুরি। অধিকার রক্ষার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশের দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করার প্রয়োজন রয়েছে। পুলিশের কার্যক্রমের ওপর পুলিশের নিজস্ব নিয়ন্ত্রণ থাকা উচিত, যা তাদের পরিচালনাগত কার্যক্রমকে আইনসম্মত করবে এবং পুলিশকে রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গ (সরকার, সংসদ ও আদালত) এবং সাধারণ জনগণের প্রতি দায়বদ্ধ রাখবে।
খসড়া প্রণয়নের সিদ্ধান্ত
নতুন পুলিশ আইন প্রণয়নের জন্য খসড়া প্রণয়ন কমিটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, পুলিশের কাজ হবে বাংলাদেশের জনগণের সেবা করা, ক্ষমতাসীনদের নয়। তারা কেবল শাস্তি প্রদানের উদ্দেশ্যে কাজ করবে না, বরং অপরাধ প্রতিরোধমূলক কর্মকাণ্ডসহ অপরাধের শিকার ব্যক্তিদের সর্বপ্রকার সহায়তা দান করবে। এই আইনের প্রণয়ন পুলিশের কার্যক্রমকে সুষ্ঠু, স্বচ্ছ এবং জবাবদিহির আওতায় নিয়ে আসবে।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও প্রত্যাশা
বর্তমান উদ্যোগের অধীনে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স জানিয়েছে, তারা পুলিশ সংস্কার আইনের খসড়া চূড়ান্ত করার জন্য কাজ করছেন এবং শিগগিরই এটি বাস্তবায়িত হবে বলে আশা করছেন। নতুন আইনের মাধ্যমে পুলিশ বাহিনীকে জনগণের সেবাদানকারী সংগঠন হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হবে, যা তাদের দায়িত্ব এবং দায়বদ্ধতার মধ্যে সামঞ্জস্য আনবে। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই সংস্কার জরুরি, নইলে ভবিষ্যতে রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় এসে পুলিশকে তাদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে পারে।
উপসংহার
বর্তমান পুলিশ সংস্কার আইন কার্যকর করতে পারলে বাংলাদেশে আইনের শাসন আরও শক্তিশালী হবে এবং জনগণের প্রতি পুলিশের দায়বদ্ধতা নিশ্চিত হবে। দেশের নাগরিকরা একটি নিরাপদ এবং নিশ্চিত পরিবেশে বাস করতে পারবে, যা তাদের মৌলিক মানবাধিকার।