স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় দেশের ১১টি জেলার ৭৭ উপজেলার ৯ লাখ ৪৬ হাজার ৭৬৯ জন মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় ৪৮ লাখ ৬৯ হাজার ২৯৯ জন মানুষ। আকস্মিক এ বন্যায় গত চার দিনে ২ নারীসহ ১৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ তথ্য গতকাল শুক্রবার দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. কামরুল হাসান সংবাদ ব্রিফিংয়ে জানিয়েছেন। পরে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকেও এ বিষয়ে একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি পাঠানো হয়।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইংয়ের তথ্য অনুযায়ী, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত জেলাগুলোর মধ্যে রয়েছে—ফেনী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, নোয়াখালী, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেট, লক্ষ্মীপুর এবং কক্সবাজার। বন্যায় দেশের ৭৭টি উপজেলা এবং ৫৮৯টি ইউনিয়ন-পৌরসভা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বন্যায় নিহতদের মধ্যে কুমিল্লায় ৪ জন, ফেনীতে ১ জন, চট্টগ্রামে ৪ জন, নোয়াখালীতে ১ জন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ১ জন, লক্ষ্মীপুরে ১ জন এবং কক্সবাজারে ৩ জনের মৃত্যু হয়েছে।
ত্রাণ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের উদ্ধারে এবং তাদের মধ্যে পর্যাপ্ত ত্রাণসামগ্রী বিতরণের জন্য ৩ হাজার ১৬০টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে ১ লাখ ৮৮ হাজার ৭৩৯ জন মানুষ এবং ১৭ হাজার ৮৪৮টি গবাদি পশুকে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্তদের চিকিত্সাসেবা প্রদানের জন্য ১১টি জেলায় ৬৩৭টি মেডিক্যাল টিম কাজ করছে।
ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব কামরুল হাসান সংবাদ ব্রিফিংয়ে আরও জানান, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে বিতরণের জন্য সরকার ৩ কোটি ৫২ লাখ নগদ টাকা, ২০ হাজার ১৫০ মেট্রিক টন চাল এবং ১৫ হাজার প্যাকেট শুকনা খাবার বরাদ্দ দিয়েছে। বন্যাকবলিত জেলাগুলোর জেলা প্রশাসকদের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, মেডিক্যাল টিম ও অন্যান্য স্বেচ্ছাসেবকদের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ে সার্বক্ষণিক কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে। তথ্য ও সহযোগিতার জন্য একটি হটলাইনও চালু করা হয়েছে।
এদিকে, চট্টগ্রামে বন্যায় ৪ জনের মৃত্যু নিশ্চিত করেছে প্রশাসন। চট্টগ্রামের ১০ উপজেলায় ২ লাখ ৬২ হাজার ৪০০ জন মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। ফটিকছড়ি উপজেলার নাজিরহাট নতুন ব্রিজ এলাকায় হালদা নদীর তীর রক্ষা বাঁধ ভেঙে গেছে, যার ফলে হাটহাজারী উপজেলার ফরহাদাবাদ ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এছাড়া ফটিকছড়ি উপজেলা ও সংলগ্ন এলাকায় পানিবন্দি অবস্থায় আছেন ১ লাখ মানুষ। টানা বর্ষণে চট্টগ্রামের গুমাই বিলে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার হেক্টর জমির রোপা আমন ধানের চারা পানিতে ডুবে গেছে। এক সপ্তাহের মধ্যে পানি না নামলে আমন চাষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
কক্সবাজারের রামুতে পানির স্রোতে নিখোঁজ চার জনের মধ্যে তিন যুবকের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। রামু উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মো. রাশেদুল ইসলাম এই বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
মৌলভীবাজারে মনু ও ধলাই নদীর ১৩টি স্থানে বাঁধ ভেঙে বন্যার পানি প্রবেশ করছে। জেলার প্রায় তিন শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়ে প্রায় চার লক্ষাধিক লোক পানিবন্দি অবস্থায় আছে। জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী জানিয়েছেন, মনু নদের পানি চাঁদনীঘাট পয়েন্টে বিপত্সীমার অনেক ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
কুমিল্লায় গোমতী নদীর বাঁধ ভেঙে ৭টি ইউনিয়নের বাসিন্দারা পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। বাঁধ ভাঙার ফলে বন্যার পানি বাড়ছে, যা নতুন নতুন এলাকাকে প্লাবিত করছে।
মিরসরাইয়ে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে এবং নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে খাবার সংকট দেখা দিয়েছে। পানির কারণে সড়কে যান চলাচলও বন্ধ রয়েছে।
ফেনীর ৯২ শতাংশ মোবাইল টাওয়ার অচল হয়ে পড়েছে, যা বন্যাকবলিত ১০ জেলার প্রায় ১১ শতাংশ টাওয়ারকেও অচল করে দিয়েছে। বিদ্যুত্ সংযোগ না থাকা এবং টাওয়ার এলাকা ডুবে যাওয়ায় নেটওয়ার্ক সচল করা সম্ভব হচ্ছে না।
পাইকেরাছায় বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় খুলনার অনেক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে, আর নোয়াখালীতে রেললাইন তলিয়ে যাওয়ায় সারা দেশের সঙ্গে ট্রেন যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।
বন্যাদুর্গত এলাকায় উদ্ধার ও ত্রাণ কার্যক্রম চালাতে হেলিকপ্টারের সহায়তা নিচ্ছে র্যাব। তারা নারী, শিশু ও বৃদ্ধসহ পানিবন্দিদের নিরাপদ স্থানে স্থানান্তর করছে এবং অক্সিজেন সাপোর্ট দিয়ে গর্ভবতী নারী ও নবজাতকদের উদ্ধার করেছে।