শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে গঠিত গণ-আন্দোলনের চাপে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর, শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। দায়িত্ব নেওয়ার পর রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় তার কার্যালয়ে নির্বাচিত কয়েকজন সাংবাদিকের সাথে আলাপকালে তিনি স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন, এটি তার নিজস্ব বিপ্লব ছিল না। তবে শিক্ষার্থীদের দেশ নিয়ে যে স্বপ্ন, সেই স্বপ্ন পূরণে তাদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে তিনি দায়িত্ব পালন করছেন। তার এই পদক্ষেপের পেছনে তরুণ প্রজন্মের স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করার উদ্দেশ্যই প্রধান।
৮৪ বছর বয়সী ড. ইউনূস বলেন, “আমি এ দায়িত্ব গ্রহণ করেছি কারণ দেশের তরুণরা এটি চেয়েছিল, এবং আমি তাদের সহায়তা করতে চেয়েছি।” তিনি আরও বলেন, “এটি আমার স্বপ্ন নয়, বরং তাদের স্বপ্ন। তাই আমি তাদের স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে সাহায্য করছি।”
ব্রিফিংয়ের সময় ড. ইউনূস দেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে বলেন, “প্রথম এবং প্রধান কাজ হলো আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা, যাতে মানুষ স্বস্তিতে থাকতে পারে এবং নিজেদের কাজে মনোযোগ দিতে পারে।” তিনি উল্লেখ করেন, শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পর তার সরকারের লোকেরা প্রায় সম্পূর্ণভাবে ‘লাপাত্তা’ হয়ে গেছেন। ১৫ বছর ধরে ক্রমবর্ধমান কর্তৃত্ববাদী শাসনের কারণে দেশজুড়ে এক বিশৃঙ্খলা, জগাখিচুড়ির সৃষ্টি হয়েছে। ড. ইউনূসের ভাষায়, “শেখ হাসিনা সরকার যা করেছে, তার কোনো অর্থ আমার কাছে নেই। তাদের প্রশাসন পরিচালনার সক্ষমতা ছিল না।”
তবে এত বিশৃঙ্খলার মধ্যেও ড. ইউনূস আশার কথা শোনান। তিনি বলেন, “আমরা এখানে আছি শিক্ষার্থীদের জন্য, দেশের জন্য। কারণ এই মুহূর্তে, দানব চলে গেছে। তাই এই উত্তেজনা।” তার মতে, সংস্কারই বর্তমান পরিস্থিতির মুখ্য বিষয়। বাকস্বাধীনতার বিষয়ে তিনি বলেন, সংস্কার অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। শেখ হাসিনার শাসনামলে বাকস্বাধীনতা ব্যাপকভাবে সীমাবদ্ধ ছিল, এবং যারা তার বিরুদ্ধে কথা বলতে চেয়েছিল, তাদের কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়েছিল। ড. ইউনূসও নিজেকে বাকস্বাধীনতার দমনের শিকার হিসেবে উল্লেখ করেন।
অধ্যাপক ড. ইউনূস শেখ হাসিনা সরকারের একজন সুস্পষ্ট সমালোচক এবং ক্ষুদ্র ঋণের অগ্রদূত হিসেবে বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত। তবে, শেখ হাসিনা তাকে ‘জনশত্রু’ হিসেবে গণ্য করেছেন এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলায় তাকে ছয় মাসের কারাদণ্ড প্রদান করা হয়েছে।
ড. ইউনূস তার অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার পরিকল্পনা নিয়ে বলেন, “আমাদের সংস্কারের তালিকায় আরও অনেক কিছু রয়েছে। প্রতিটি মন্ত্রণালয়ে শিক্ষার্থীদের একটি আসন থাকবে, যা পূর্ববর্তী প্রশাসনের অবসানে তাদের অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে।” সরকারবিরোধী বিক্ষোভে নেতৃত্ব দেওয়া নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদ ইতোমধ্যে তার উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য হিসেবে যোগ দিয়েছেন।
তিনি বিচার বিভাগের সংস্কার প্রসঙ্গে বলেন, বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে কাজ করতে ব্যর্থ হয়েছে। অতীতে বিচারকরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে কাজ করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ড. ইউনূস বলেন, “যিনি প্রধান বিচারপতি ছিলেন, তিনি আসলে ছিলেন একজন জল্লাদ।”
অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যক্রম প্রসঙ্গে ড. ইউনূস বলেন, “আমাদের এমন কিছু সিদ্ধান্ত নিতে হবে, যা সবার পছন্দ নাও হতে পারে। তবে আমরা আশা করি, পূর্ববর্তী সরকারের তুলনায় আমাদের কার্যক্রম ভালো কিছু বয়ে আনবে।” তিনি আরও যোগ করেন, “আমার কাজের অভিজ্ঞতা যা-ই থাক না কেন, আমি বলছি না যে আমি সরকার চালাতে পারব। তবে আমার কিছু প্রতিষ্ঠান চালানোর অভিজ্ঞতা আছে, যা আমি কাজে লাগাব। কিছু মানুষ এটি পছন্দ করবে, কিছু অপছন্দ করবে, কিন্তু আমাদের এর মধ্য দিয়েই এগোতে হবে।”