বাংলাদেশে কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে শুরু হওয়া গণআন্দোলনের জেরে দেশের রাজনীতিতে এক অশান্ত অধ্যায় শুরু হয়। এই আন্দোলনের পটভূমিতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে ব্যাপক সমালোচনা ও আন্দোলন দানা বাঁধে। বিশেষ করে, আন্দোলনের সময়ে সংঘটিত সহিংসতার পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ ওঠে। শেষ পর্যন্ত, এই আন্দোলন একটি গণ-অভ্যুত্থানে রূপ নেয়, যা প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ এবং দেশের বাইরে চলে যাওয়ার মাধ্যমে শেষ হয়। আন্দোলনের উত্তাল পরিস্থিতির পর দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ে। এই অস্থিরতার মাঝে, আইন শৃঙ্খলা বাহিনী আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের গ্রেপ্তার করতে শুরু করে।
এরই মধ্যে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি) একটি চাঞ্চল্যকর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে, যা দেশ-বিদেশে তুমুল আলোচনার জন্ম দিয়েছে। কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় সংঘটিত সহিংসতা, হত্যা এবং নির্যাতনের অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ নয়জনের বিরুদ্ধে তদন্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ট্রাইব্যুনাল। এই সিদ্ধান্তটি আসে এমন এক সময়ে, যখন এক ছাত্রের বাবা শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ দায়ের করেন। এই অভিযোগটি মানবতাবিরোধী অপরাধ, গণহত্যা এবং অন্যান্য সহিংস অপরাধের সাথে সম্পর্কিত।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল এই প্রসঙ্গে একটি বিবৃতি দিয়ে বলেন, “আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের আওতায় সাবেক সরকার প্রধানসহ যারা এসব অপরাধে জড়িত, তাদের বিচার করা হবে। কোনো ধরনের ছাড় দেওয়া হবে না।” এই মন্তব্যের মাধ্যমে তিনি ইঙ্গিত দেন যে, আইনগত প্রক্রিয়া শুরু হচ্ছে এবং এই বিচারে কোনো ধরনের বাধা থাকবে না।
তবে, প্রশ্ন উঠেছে যে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন অনুযায়ী, শেখ হাসিনার মতো একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগে বিচার করা সম্ভব কি না। এই আইনের আওতায় মূলত ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার করা হতো। ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর, আওয়ামী লীগ সরকার এই আইনকে পুনঃপ্রকাশ করে এবং এর আওতায় যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের উদ্যোগ গ্রহণ করে। কিন্তু বর্তমানে কোটা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে এই আইন কীভাবে প্রযোজ্য হতে পারে তা নিয়ে বিতর্ক চলছে।
১৯৭৩ সালে প্রণীত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের ৩(১) ধারায় বলা হয়েছে, মানবতাবিরোধী অপরাধ, শান্তিবিরোধী অপরাধ, গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ, এবং জেনেভা কনভেনশন বিরোধী কাজের জন্য অভিযুক্ত ব্যক্তি, দল বা সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের বিচার করা সম্ভব। অ্যাটর্নি জেনারেল মো: আসাদুজ্জামান এ বিষয়ে বলেন, “১৯৭৩-এর যে আইনটা আছে, ওখানে ক্রাইম এগেইন্সট হিউম্যানিটির (মানবতাবিরোধী অপরাধ) সংজ্ঞা অনুসারে এটি অপরাধ হিসেবে আসে।”
এই আইনের অধীনে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে বিচার প্রক্রিয়া শুরু করা সম্ভব বলে অনেকেই মনে করছেন। সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মনজিল মোরশেদ বলেছেন, “আইন যেভাবে আছে, সেই বিবেচনায় ক্রাইম এগেইন্সট হিউম্যানিটি বা জেনোসাইড এসব বিষয় সেখানে বিচার করার সুযোগ আছে।” তার মতে, আইনে শেখ হাসিনাসহ অন্যান্য অভিযুক্তদের বিচার করতে কোনো আইনগত বাধা নেই।
অন্যদিকে, এই আইনের প্রাক্তন প্রসিকিউটর রানা দাশগুপ্ত ভিন্ন মত পোষণ করেন। তিনি মনে করেন, “এই আইনটি ১৯৭১ সালের প্রেক্ষাপটে করা হয়েছিল, যারা যুদ্ধাপরাধ করেছে, তাদের বিচার করার জন্য। ফলে এখন যে প্রেক্ষাপটে বিচারের কথা বলা হচ্ছে, তা প্রযোজ্য হয় না।”
কোটা আন্দোলনের সময় সহিংসতায় নিহতদের পরিবার থেকে একাধিক মামলা দায়ের করা হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত মামলা হলো, সাভারে গুলিবিদ্ধ নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী আলিফ আহমেদ সিয়ামের হত্যার ঘটনায় দায়ের করা মামলা। এই মামলায় শেখ হাসিনাসহ নয়জনের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে। সিয়ামের বাবা বুলবুল কবিরের পক্ষে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী গাজী এমএইচ তানিম আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থায় অভিযোগ দায়ের করেন।
এছাড়া, মিরপুরে কলেজ শিক্ষার্থী ফয়জুল ইসলাম রাজনের হত্যার অভিযোগে শেখ হাসিনাসহ ২৪ জনের বিরুদ্ধে আরেকটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় শাহাবুদ্দিন নামে এক অটোরিকশা চালকের হত্যার অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে আরও একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে।
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো এবং তাদের আইসিটি-তে বিচারের উদ্যোগ দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে। দেশের জনগণ এবং আন্তর্জাতিক মহল এই বিচার প্রক্রিয়ার প্রতি গভীর নজর রাখছে। শেখ হাসিনার মতো একজন প্রভাবশালী নেত্রীর বিরুদ্ধে এই ধরনের বিচার প্রক্রিয়া কি রূপ নেবে এবং এর পরিণাম কী হতে পারে তা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা চলছে।
সূত্র : বিবিসি