গত ১৬ বছরে সরকারের আনুকূল্যে সীমিত সংখ্যক ব্যবসায়ী ব্যাংক লুট, অর্থ পাচার ও শেয়ারবাজার লোপাটের মতো কার্যকলাপের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিকে বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছে। এর প্রভাব এতটাই গভীর হয়েছে যে সাধারণ ব্যবসায়ীরা প্রকাশ্যে তাদের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস পাননি। এই পরিস্থিতিতে ব্যবসায়ী সমিতি ও চেম্বারগুলো রাজনৈতিক প্রভাবের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে, যা ব্যবসায়ী সমাজের জন্য এক অশনি সংকেত।
বুধবার রাজধানীর একটি হোটেলে ব্যবসায়ী সমাজের ব্যানারে আয়োজিত এক সম্মেলনে সাধারণ ব্যবসায়ীরা এসব গুরুতর বিষয় তুলে ধরেন। ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স বাংলাদেশের সভাপতি মাহবুবুর রহমানের সভাপতিত্বে আয়োজিত এ সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন এফবিসিসিআই-এর সাবেক সভাপতি আব্দুল আউয়াল মিন্টু, এ কে আজাদ, মীর নাসির হোসেন, এবং অন্যান্য বিশিষ্ট ব্যবসায়ী নেতারা।
সম্মেলনে এফবিসিসিআই-এর সাবেক পরিচালক আব্দুল হক বলেন, “সরকারের সমর্থনে কিছু প্রভাবশালী ব্যবসায়ী রাতের আঁধারে ব্যাংক দখল করে লুটপাট চালিয়েছে। এই লুটপাটের কারণে অর্থনীতির ভীত নড়বড়ে হয়ে গেছে। এদের অনৈতিক কর্মকাণ্ডের ফলে টাকার মান কমেছে, মূল্যস্ফীতি বেড়েছে, এবং সাধারণ ব্যবসায়ীরা মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। আমরা তাদের বিরুদ্ধে একটি শ্বেতপত্র প্রকাশের দাবি জানাই।”
সুইং থ্রেড অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আবুল কাশেম হায়দার জানান, “গত ১৬ বছর ধরে ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো মূলত রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। সাধারণ ব্যবসায়ীরা তাদের সমস্যা নিয়ে কথা বলার সুযোগ পাননি। এফবিসিসিআই-এর নমিনেশন প্রথা বাতিল করে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে হবে। আমরা চাই, যারা ব্যাংক ও শেয়ারবাজার লুট করেছে, তাদের আইনের আওতায় আনা হোক।”
এ কে আজাদ পোশাকশিল্পের ক্রেতাদের উদ্বেগের কথা তুলে ধরে বলেন, “দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে বিদেশি ক্রেতারা আতঙ্কিত। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে দ্রুত এ বিষয়ে আন্তর্জাতিকভাবে বার্তা দিতে হবে এবং আইনশৃঙ্খলা স্বাভাবিক করার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে।”
মীর নাসির হোসেন বলেন, “একটি বিশেষ গোষ্ঠী ব্যাংকগুলোকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসায় সাধারণ ব্যবসায়ীরা ঋণ পেতে ব্যর্থ হয়েছেন। সুদের হার বেড়েছে, এবং ব্যবসায়িক কার্যক্রম ব্যাহত হয়েছে। ভবিষ্যতে এই ধরনের ঘটনা প্রতিরোধে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার প্রয়োজন, যা কেবল অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনেই সম্ভব।”
বিজিএমইএ-এর সাবেক সভাপতি কাজী মনিরুজ্জামান উল্লেখ করেন, “সরকারের আনুকূল্যে গত ১৬ বছরে ব্যাংক থেকে লক্ষ কোটি টাকা পাচার ও লুট হয়েছে। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য ড. ইউনূসের আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা কাজে লাগিয়ে অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলা করা হবে বলে আমরা আশা করি।”
এফবিসিসিআই-এর সাবেক পরিচালক আনোয়ার হোসেন বলেন, “ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো এতদিন সরকারের দাসত্ব করেছে। যারা শেয়ারবাজার লুট করেছে, তারাই সংগঠনগুলোতে প্রভাব বিস্তার করেছে।”
এফবিসিসিআই-এর সাবেক সভাপতি আব্দুল আউয়াল মিন্টু জানান, “দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি, সামাজিক অবস্থা, এবং বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধি সবকিছুতেই নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এ অবস্থার উত্তরণ ঘটাতে হলে গণতান্ত্রিক পরিবেশ এবং জবাবদিহিমূলক সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে।”
সম্মেলনে আরও বক্তব্য দেন স্কয়ার গ্রুপের পরিচালক তপন চৌধুরী, বিটিএমএ সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল, ঢাকা চেম্বারের বর্তমান সভাপতি আশরাফ আহমেদ, সাবেক সভাপতি রিজওয়ান রাহমান, সবুর খান, সিলেট চেম্বারের আলিমুল এহসান, এবং এফবিসিসিআই-এর সাবেক পরিচালক জালাল উদ্দিন, আব্দুল ওয়াহেদ, আফজাল হোসেন প্রমুখ।
ব্যবসায়ীদের এই সম্মেলন দেশের অর্থনীতির ভবিষ্যৎ নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এবং একে কেন্দ্র করে সংস্কারের আহ্বান জানিয়েছে। শীর্ষ ব্যবসায়ী নেতারা আশা করছেন, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশের স্বার্থে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে এবং অনৈতিক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।