২০১৩ সালের ৫ এবং ৬ মে রাজধানীর মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশকে কেন্দ্র করে নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে বিচারবহির্ভূতভাবে নিহত ব্যক্তিদের একটি তালিকা প্রকাশ করেছে মানবাধিকার সংস্থা অধিকার। সংস্থাটি সোমবার, ১৯ আগস্ট, তাদের ফেসবুক পেজে এই তালিকা প্রকাশ করে, যা দেশব্যাপী নতুন করে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আসে।
অধিকার সংস্থা জানায়, ২০১৩ সালে তারা নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে সংঘটিত নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞের একটি তথ্যানুসন্ধান মিশন পরিচালনা করে। এই মিশনের পরিপ্রেক্ষিতে সংস্থাটি ৬১ জন নিহতের তথ্য উল্লেখ করে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, হেফাজতে ইসলামের সমাবেশের সময় নিরাপত্তা বাহিনী কর্তৃক সংঘটিত হত্যাকাণ্ড ছিল সম্পূর্ণভাবে বিচারবহির্ভূত এবং এটি মানবাধিকার লঙ্ঘনের একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
প্রতিবেদন প্রকাশের পরপরই আওয়ামী লীগ সরকার অধিকার এর তৎকালীন সেক্রেটারি আদিলুর রহমান খান এবং সংস্থার বর্তমান পরিচালক এ এস এম নাসির উদ্দিন এলানের বিরুদ্ধে মামলা করে। এই মামলা করা হয় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) আইন, ২০০৬ (সংশোধিত ২০০৯)-এর ৫৭ ধারায়। সরকারের অভিযোগ ছিল, অধিকার সংস্থা এবং এর নেতারা তথ্য বিকৃতি এবং রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রচারণা চালিয়েছে।
অধিকার সংস্থার দাবি, ২০১৩ সাল থেকে আওয়ামী লীগ সরকার এই সংস্থা এবং এর নেতাদের বিরুদ্ধে একটি পরিকল্পিত নিপীড়ন ও হয়রানির কৌশল নিয়েছে। সরকার এবং সরকারপন্থী মিডিয়ার মাধ্যমে অধিকারকে জনমনে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করা হয়েছে। সংস্থার নেতারা শুধু প্রশাসনিক হয়রানির শিকার হননি, তাদের ওপর নজরদারি বাড়ানো হয়েছে, এবং তাদের কর্মকাণ্ডে বাধা দেওয়া হয়েছে। এক দশকেরও বেশি সময় ধরে চলে আসা এই বিচারিক হয়রানি পরিণত হয় ২০২৩ সালে যখন আদিলুর রহমান খান এবং এ এস এম নাসির উদ্দিন এলানকে দুই বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
গত ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩ তারিখে, ঢাকা সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিচারক এ এম জুলফিকার হায়াৎ আদিলুর রহমান খান এবং এ এস এম নাসির উদ্দিন এলানের বিরুদ্ধে রায় ঘোষণা করেন। রায়ে বলা হয়, আইসিটি আইনের অধীনে তাদের ১০,০০০ টাকা জরিমানা এবং দুই বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এতে তাদের দোষী সাব্যস্ত করা হয় একটি সত্য অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশের জন্য, যা রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করেছে বলে অভিযোগ ছিল।
তবে, তাদের সাজা ঘোষণার ৩১ দিন পর, সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি মো. এমদাদুল হক আজাদ তাদের জামিন মঞ্জুর করেন। ১৫ অক্টোবর ২০২৩, আদিলুর রহমান খান এবং এ এস এম নাসির উদ্দিন এলান ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্তি পান।
অধিকার সংস্থা তাদের তালিকা প্রকাশের মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকারকে একটি স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠনের আহ্বান জানিয়েছে। তারা দাবি করে, এই কমিশনের নেতৃত্বে থাকা উচিত সুপ্রিম কোর্টের একজন সম্মানিত বিচারক, যার নেতৃত্বে ৫ ও ৬ মে ২০১৩ সালে সংঘটিত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের নিরপেক্ষ তদন্ত করা হবে। সংস্থাটি আরও বলেছে, দোষীদের বিচারের আওতায় আনার জন্য অবিলম্বে পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।
অধিকারের এই আহ্বান এবং তালিকা প্রকাশ নতুন করে ২০১৩ সালের সেই বিতর্কিত ঘটনাগুলোকে সামনে নিয়ে এসেছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের এমন অভিযোগগুলো পুনর্বিবেচনার দাবি উঠছে বিভিন্ন মহল থেকে, এবং অধিকার সংস্থা নিরপেক্ষ তদন্ত ও বিচারের মাধ্যমে প্রকৃত দোষীদের চিহ্নিত করার ওপর গুরুত্বারোপ করছে। দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এই ঘটনার পুনরুত্থান নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে এবং অধিকার সংস্থার ওপর সরকারের ক্রমাগত চাপ এবং দমন-পীড়নের বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।