আজ আমার জন্মদিন।
জন্মদিনে নিজেকে কোনোদিন কিছু উপহার দেইনি। তবে পেয়েছি ঢের। সে অর্থে, এবারের জন্মদিনটি অবশ্যই আলাদা। নিজেকে আজ এমন কিছু একটা উপহার দিতে চলেছি, যার জন্য অপেক্ষায় ছিলাম দীর্ঘদিন।
কিছুক্ষণ পর চ্যানেল টোয়েন্টিফোরে যে রিপোর্টটি আপনারা দেখবেন, সেই রিপোর্টটিকে বলতে পারেন ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা কাজের একটি টিজার। এরপর ট্রেইলার আসবে। তারপর দেখবেন পূর্ণাঙ্গ মুভি।
একটি ভালো অনুসন্ধানী রিপোর্টের জন্য আপনি ঠিক কতদিন লেগে থাকবেন বা থাকতে পারবেন? পনের দিন, এক মাস, ছয় মাস বা এক বছর? এত সময় অবশ্য বাংলাদেশের গণমাধ্যমে পাওয়া সম্ভব নয়। কানাডায় আমরা একটি ভালো ইনভেস্টিগেটিভ-ডকের জন্য ৭-৮ মাসও পাই। খুব ভালো কিছু হলে হয়তো ১ বছর। বাংলাদেশে সেটি সর্বোচ্চ দু-মাস।
কিন্তু আমি এই কাজটির পেছনে লেগে ছিলাম প্রায় ৬ বছর!
এতদিন কি লাগার কথা? মাঝে কোভিড, আমার কানাডায় কাজের সুযোগ, অন্যান্য বড় বড় কাজে যুক্ত হওয়া এবং চক্রটির সূত্র মেলাতে না পারার ব্যর্থতাসহ নানা কারণ অবশ্য ছিল। তবে যাই থাকুক, ৬ বছর অবশ্যই একটি দীর্ঘ সময়।
বাংলাদেশ ছেড়ে যখন কানাডায় সাংবাদিকতা শুরু করলাম, বুক ও ব্যাগের ভেতর যে কয়েকটি অসমাপ্ত কাজের ফাইলপত্র, নোট এবং তীব্র প্রত্যয় নিয়ে এসেছিলাম, এই কাজটি শীর্ষে ছিল। যখনই সময় পেয়েছি, ডট মিলিয়েছি।
আরেক মহাদেশে সময় মিলিয়ে অনুসন্ধানে প্রাপ্ত ফলাফল বিশ্লেষণ, ক্রস-চেক, সোর্স-মেইনটেইন, মাঠের কাজ তদারকি, রিপোর্ট তৈরি এবং তা প্রচার যে কতটা মানসিক এবং শারিরিক শ্রমের তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি গত ১৫টা দিন।
শেষ পর্যন্ত খবরটি আজ ব্রেক করতে যাচ্ছি।
শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন-বিপিএসসির নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁসের প্রমাণ পেয়েছি আমরা। গেল শুক্রবার অনুষ্ঠিত রেলওয়ের ৫১৬টি পদের এই নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসে জড়িত খোদ পিএসসির কর্মকর্তারাই!
দীর্ঘ অনুসন্ধানে বিপিএসসিকেন্দ্রীক এই চক্রটিকে চিহ্নিত করেছি আমরা, যারা এক যুগেরও বেশি সময় ধরে বিসিএসের প্রিলি, রিটেন, ভাইভাসহ গুরুত্বপূর্ণ প্রায় সকল সরকারি নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস করেছে। সর্বশেষ ৪৬তম বিসিএসও বাদ যায়নি এদের খপ্পড় থেকে।
এই অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্য একজন বাংলাদেশী নাগরিক হিসেবে শিউরে ওঠার মতোই, কেননা সাংবিধানিক এই প্রতিষ্ঠানটির মুখের দিকে তাকিয়ে বসে থাকে লাখ লাখ বেকার তরুণ-তরুণী।
জীবনের শুরুর ৩০ বছরের প্রায় সকল সুখ আর চাওয়া-পাওয়া বিসর্জণ দিয়ে বিসিএস ধ্যান-জ্ঞান করে, নিদেন পক্ষে পিএসসির একটি নন-ক্যাডার প্রথম বা দ্বিতীয় শ্রেণীর চাকরির আশায় যারা দিন গুণেন , লাইব্রেরীতে পড়ে থাকেন দিনের পর দিন, তাদের জন্য এ খবর রীতিমতো বজ্রাঘাত! রাষ্ট্রের তরফে প্রহসন।
বিসিএস এবং পিএসসি নন-ক্যাডার চাকরির প্রশ্নপত্র ফাঁসের সর্ববৃহৎ এই চক্রের কার্যক্রম এবং তাদের বিস্তারিত জানতে আপনাদের অপেক্ষা করতে হবে আগামী পর্বের সার্চলাইটের জন্য। তবে একাধিক পর্ব হয়তো লেগে যাবে পুরো গল্পটি তুলে ধরতে।
শেষ মুহুর্তে রিপোর্টটির জন্য সহকর্মীদের পাঠিয়ে পিএসসি চেয়ারম্যানের একটা ইন্টারভিউ করেছি আমি। ইন্টারভিউ শেষে তিনি আমাকে কল করেন এবং প্রায় ৪০ মিনিট কথা বলেন। এত অসহায় লাগল তার কন্ঠ! মনটা কিছুটা খারাপই হলো।
কিন্তু রাষ্ট্রের কাজে দক্ষ কর্মী খুঁজে বের করার সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটির প্রধান হয়ে এভাবে একের পর এক প্রশ্নফাঁসের ঘটনার দায় তিনি আর তার বোর্ডের সদস্যরা কিভাবে এড়াবেন? একটি দুটি তো নয়, ৩৩তম বিসিএস থেকে প্রায় ৩০টি ক্যাডার-ননক্যাডাার পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁসের প্রমাণ পেয়েছি আমরা।
জন্মদিন যে কখন এলো আর গেল, টেরই পাইনি। বউ ভয়ে একটা কেক কাটার প্রস্তাবও দিতে পারেনি! ছেলেটাকে কোলে নেওয়া হয়নি, কয়েক রাত ঘুম নাই। তবু লাখ লাখ বেকার ভাই-বোনের জন্য কিছু করতে পারার আনন্দের তূল্য তো আর কিছু নেই, আর সেই দিনটি জন্মদিন হলে তো কথাই নেই।
ওয়েল ডান আবদুল্লাহ আল ইমরান,
Post Views: ১৮৮