বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার গুমের ঘটনা তদন্তে একটি বিশেষ কমিশন গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই কমিশন বিভিন্ন সময়ে ঘটে যাওয়া গুমের ঘটনা, তাদের কারণ, এবং কারা এর সঙ্গে জড়িত তা নিয়ে গভীরভাবে তদন্ত করবে। এই সিদ্ধান্তের লক্ষ্য হলো ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা এবং যারা গুমের শিকার হয়েছেন, তাদের পরিবারকে সান্ত্বনা দেওয়া।
বৃহস্পতিবার (২২ আগস্ট) রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের এক সভায় এই গুরুত্বপূর্ণ নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সভার পর, সিদ্ধান্তগুলো সাংবাদিকদের সামনে তুলে ধরেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানিসম্পদ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তিনি এ সময় উল্লেখ করেন, গুমের ঘটনাগুলো নিয়ে কমিশনের তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত সত্য উদঘাটন করা হবে এবং যারা দোষী তাদের আইনের আওতায় আনা হবে।
সভায় আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত হয়, যেখানে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে হতাহত ব্যক্তিদের সহায়তার জন্য একটি ফাউন্ডেশন গঠনের কথা ঘোষণা করা হয়। এই ফাউন্ডেশনের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ফাউন্ডেশনের লক্ষ্য থাকবে আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসা, পুনর্বাসন, এবং গণ-অভ্যুত্থানের স্মৃতি ধরে রাখা। ফাউন্ডেশনটি পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকবে হতাহত ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যরা, যারা এই ঘটনার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত।
বাংলাদেশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনার নামকরণের বিষয়ে একটি নীতিমালা করারও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান জানান, যখন জনগণের অর্থ ব্যয় করে কোনো প্রকল্প বা স্থাপনা গড়ে তোলা হয়, তখন তার নামকরণে এমন একটি নীতি অনুসরণ করতে হবে, যা জনমতের প্রতিফলন ঘটাবে এবং কোনোভাবেই ‘ফ্যাসিবাদ’কে উসকে দেবে না। তিনি আরও বলেন, রাজনৈতিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে যাতে নাম নিয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না হয়, তা নিশ্চিত করতে এই নীতিমালাকে আইনি কাঠামোর মধ্যে আনা হবে।
আইনি প্রক্রিয়াগুলো পরিচালনার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার জন্যও কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে এই সভায়। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী এ বিষয়ে কয়েকজন উপদেষ্টা এবং দেশের আইনবিশেষজ্ঞদের সঙ্গে বৈঠক করবেন। তাদের আলোচনা থেকে নির্ধারণ করা হবে কোথায় কী ধরনের নির্দেশনা প্রয়োজন এবং তা কীভাবে কার্যকর করা যাবে।
বৈঠকে দাবিদাওয়া নিয়ে বিক্ষোভ এবং প্রতিবাদের বিষয়েও আলোচনা হয়। সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, প্রতিবাদের অধিকার সবার রয়েছে এবং অনেক বছর ধরে মানুষ অনেক কিছু বলতে পারেনি। কিন্তু এই প্রতিবাদ যাতে জনজীবনে অতিরিক্ত অসুবিধার সৃষ্টি না করে, তা নিশ্চিত করতে সরকারের পক্ষ থেকে বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হবে। আন্দোলনকারীদের মুখপাত্র এবং সরকারের মুখপাত্রদের মধ্যে আলোচনা কীভাবে ফলপ্রসূ করা যায়, তা নিয়েও উপায় খুঁজে বের করা হবে।
উপকূলীয় মৎস্য আহরণে বিদেশি ট্রলার যাতে প্রবেশ করতে না পারে, সে জন্য কোস্টগার্ডকে বিশেষ নির্দেশনা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, উপকূলীয় এলাকায় মৎস্য সম্পদ রক্ষায় সরকার সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে এবং এ ক্ষেত্রে কোনো ধরনের ছাড় দেওয়া হবে না।
আজকের বৈঠকে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে আরও জানানো হয়, বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন আইনের ৩৪ ক ধারা বিলুপ্ত করে একটি নতুন অধ্যাদেশ জারির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এই অধ্যাদেশের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং গ্যাসসম্পদ ও পেট্রোলিয়ামজাত দ্রব্যের মূল্য নির্ধারণ গণশুনানির মাধ্যমে করা হবে। এটি নির্বাহী আদেশে করা যাবে না, যা বিদ্যুৎ এবং জ্বালানি খাতে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করবে।
সভায় শেখ হাসিনা জাতীয় যুব উন্নয়ন ইনস্টিটিউট (সংশোধন) অধ্যাদেশের খসড়া অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এই অধ্যাদেশের মাধ্যমে ইনস্টিটিউটের নাম থেকে ‘শেখ হাসিনা’ বাদ দিয়ে শুধু ‘জাতীয় যুব উন্নয়ন ইনস্টিটিউট’ করা হবে। এছাড়া, সরকারি অর্থে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বা স্থাপনার নামকরণের ক্ষেত্রে আইনি কাঠামো প্রণয়নের জন্য একটি কমিটি গঠনের সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়েছে। এটি নিশ্চিত করবে যে নামকরণ প্রক্রিয়া সর্বদা ন্যায্য ও স্বচ্ছ থাকবে।
এই সব সিদ্ধান্তের মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকার দেশকে একটি সুসংবদ্ধ এবং গণতান্ত্রিক কাঠামোর দিকে এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। জনগণের অধিকার এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য গৃহীত পদক্ষেপগুলো দেশের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা হচ্ছে।